হৃদয়ের সুস্থতায় করনীয়
 September 26, 2020
September 26, 2020
                                        
                                            
                                             2283 Views
2283 Views
                                        
                                        
                                            
                                     
                                        হৃদয় দিয়ে হৃদ্রোগ প্রতিরোধ—এ বছরের বিশ্ব হার্ট দিবসের প্রতিপাদ্য। করোনাকালে এই স্লোগানের তাৎপর্যও অনেক। করোনা হলে রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।
এখন জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘরের বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। যে ঝুঁকি হৃদ্রোগীদের জন্য আরও বেশি।
অনেকেরই জানা, বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হৃদ্রোগ। প্রতিবছর বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার ৩১ শতাংশ মারা যায় নানা রকমের হৃদ্রোগে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ২ কোটি ৩০ লাখ লোক মারা যাবে হৃদ্রোগে। বাংলাদেশেও বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো হৃদ্রোগ।
ভৌগোলিক কারণেই অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেশি। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়স থেকে ধূমপান করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। কোন খাবার স্বাস্থ্যকর আর কোনটা অস্বাস্থ্যকর, সে বিষয়ে আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা কম। আবার ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম, কিন্তু ভুঁড়ি বড়, তাদের হৃৎপিণ্ডের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে, যা সাধারণত অল্পতেই কোলেস্টেরলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তার ওপর করোনায় বেড়েছে হৃদ্রোগের ঝুঁকি।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগে মারা যাওয়া প্রথম রোগীরও ছিল হৃদ্রোগ, তাঁর হার্টের করোনারি ধমনিতে রিং পরানো ছিল। এ ছাড়া আরও অনেক কোভিড-১৯ রোগী যাঁরা হার্টের রক্তনালিতে ব্লকজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন, তাঁদের পরিণতি খারাপ হয়েছে। নতুন করেও অনেকে ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন করোনার ছোবলের পর।
করোনাভাইরাসের কারণে কী ধরনের হৃদ্রোগ হতে পারে অথবা যারা ইতিমধ্যে হৃদ্রোগে ভুগছে, তাদের কী কী সমস্যা হতে পারে—নতুন স্বাভাবিক জীবনে হৃদ্রোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
হার্ট অ্যাটাক
আগে ধারণা করা হতো করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসের ক্ষতি করে বেশি। এ কারণে কোভিড-১৯ রোগীদের শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, কোভিড ভাইরাস হার্টের মাংসপেশির ক্ষতি করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যেসব কোভিড-১৯ রোগী ভেন্টিলেটর সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি পাঁচজনের একজনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। আমাদের হার্ট করোনারি ধমনির মাধ্যমে পুষ্টি পায়। এই করোনারি ধমনিতে চর্বি জমা হয়ে যদি আংশিক ব্লক থাকে, করোনার প্রভাবে তা শতভাগ ব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এমনকি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এসব রোগীর শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বুকব্যথাও হতে পারে। তবে রোগী যদি দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা না-ও থাকতে পারে।
ইসিজি ও রক্তের ট্রপোনিন আই নামের বায়ো মার্কার পরীক্ষা করে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত হওয়া যায়। হার্ট অ্যাটাক সঠিক সময়ে শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসাও সহজ হয়। টাইপ-১ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন রক্তে চর্বি জমার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু কোভিড-১৯ টাইপ-২ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, অর্থাৎ হাইপোক্সিয়া বা অক্সিজেনের অভাবজনিত কারণে হতে পারে। এ এক ভিন্নধর্মী হার্ট অ্যাটাক।
মায়োকার্ডাইটিস
মায়োকার্ডাইটিস হলো হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির প্রদাহ। করোনাভাইরাসের কারণে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশিতে আঘাতের কারণে মায়োকার্ডাইটিস হতে পারে। মায়োকার্ডাইটিস হার্টের এমন একটি অবস্থা, যা থেকে রোগী এমনি এমনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে পারে, আবার মারাত্মক জটিলতা হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষা করে এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মায়োকার্ডাইটিস শনাক্ত করা যেতে পারে।
হার্ট ফেইলিউর
হার্ট ফেইলিউর দুই ধরনের—ক্রনিক হার্ট ফেইলিউর, মানে আগে থেকেই রোগীর হার্ট দুর্বল ছিল বা হার্টের কার্যক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। এ ধরনের রোগীদের হার্ট আকারে বড় হয়ে সংকোচন-প্রসারণক্ষমতা কমে যায়।
অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিউর হঠাৎ করেই হতে পারে। হার্টের সংকোচন-প্রসারণের কার্যক্ষমতা লোপ পেয়ে রোগীর আকস্মিক শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। করোনায় সংক্রমণের কারণে ক্রনিক হার্ট ফেইলিউরের রোগীরা তো বিশেষ ঝুঁকিতে থাকেনই, আগে ভালো থাকা হার্টেও হঠাৎ অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন
করোনাভাইরাসের কারণে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ব্যাহত হতে পারে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়, ড্রপ বিটসহ নানা ধরনের অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হতে পারে। এ অবস্থাও এমনতেই ভালো হয়ে যেতে পারে, আবার বড় ধরনের সমস্যাও করতে পারে। তবে যেসব রোগী করোনার প্রভাবমুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাঁদেরও পরবর্তী সময়ে কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে এবং চিকিৎসকের কাছে ফলোআপেরও প্রয়োজন আছে।
সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের রোগী যদি হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে, তাহলে সরাসরি ক্যাথল্যাবে করোনারি এনজিওগ্রাম করে করোনারি এনজিওপ্লাস্টি করা হয়। এ চিকিৎসাকে বলা হয় প্রাইমারি পিসিআই। এই চিকিৎসাকে সারা বিশ্বে হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক হলে রক্ত পাতলা করার বিশেষ ওষুধ দ্বারা এ চিকিৎসা দেওয়া হয়।
হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে যা করবেন
- যেকোনো নতুন উপসর্গ যেমন জ্বর, শ্বাসকষ্ট শরীরব্যথা অথবা ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অবহেলা বা দেরি করবেন না।
- কিছু রুটিন পরীক্ষা করে নিজের শরীরের হালনাগাদ অবস্থা জেনে নিন।
- বুকে ব্যথা, বুকে চাপ অথবা শ্বাসকষ্ট হলে অবহেলা করবেন না।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করবেন না। এ ছাড়া নতুন কোনো ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রেও আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ডায়াবেটিস থাকলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। বাড়িতে গ্লুকোমিটার দিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
- উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ওষুধ সেবন করতে ভুল করবেন না। রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে রক্তের চাপ কত আছে জেনে নিন।
- নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়ামের অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। বাড়িতে ট্রেডমিল মেশিন থাকলে সেটিও ব্যবহার করতে পারেন।
- কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলুন।
- হার্টের কার্যক্ষমতা ভালো থাকলে পরিমিত পানি পান করবেন। হার্ট দুর্বল হলে বা হার্ট ফেইলিউর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তরল গ্রহণ করুন।
- শাকসবজি কাঁচা ফলমূল ভালো করে ধুয়ে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন।
- চিনি ও লবণ এড়িয়ে চলুন।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ খাবার ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।
- ধূমপান করবেন না। এ ছাড়া সব রকমের তামাকজাতীয় দ্রব্য বর্জন করুন।
- করোনা প্রতিরোধক স্বাস্থ্যবিধি, বারবার হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা—এসব অবশ্যই মেনে চলতে হবে। হার্টের রোগীরা কারণ ছাড়া বাইরে ভিড়ে যাবেন না।
অনেক হৃদ্রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তাই আতঙ্কিত হবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে যাপিত জীবনে ছন্দপতন হবে না। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করুন। জীবনকে জয়ী করতে হলে করোনাকে হারাতে হবে।
অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান : কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা



 
                                