রক্তচাপ থাকুক নিয়ন্ত্রণে
 October 17, 2020
October 17, 2020
                                        
                                            
                                             1757 Views
1757 Views
                                        
                                        
                                            
                                     
                                        এমনিতে ১৭ মে পালিত হলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে এবার বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালন করা হচ্ছে ১৭ অক্টোবর।
এই দিবসের প্রতিপাদ্য—‘রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন ও বেশি দিন বাঁচুন’। উচ্চ রক্তচাপ এবং এর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক আবদুল মালিক।
উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক। বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ হলো কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদ্রোগ ও রক্তনালির রোগ। এর প্রধানতম কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। সেই ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ সালে আমি যখন তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কর্মরত ছিলাম, তখন ঢাকা ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় হৃদ্রোগের প্রকোপের ওপর একটি জরিপ করা হয়েছিল। তখন উচ্চ রক্তচাপ ছিল এক নম্বর হৃদ্রোগ। এখনো হৃদ্রোগের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এক নম্বরেই আছে।
বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২০-২৫ শতাংশ মানুষই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ফেইলিওর আর স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ এই উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উচ্চ রক্তচাপের ৫০ শতাংশ রোগীই জানেন না, যে তাঁর এটি আছে। অনেক সমাজে এই জানার হার আরও কম। তার কারণ সচেতনতার অভাব। বেশির ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপের কারণে কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। এটিও একটি বড় কারণ। যার তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে না, তিনি ভাবেন কেন ডাক্তারের কাছে যাবেন, কেনই–বা ওষুধ খাবেন। ফলে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ অনির্ণীত ও চিকিৎসার বাইরেই থেকে যায়। তারপর একদিন হঠাৎ হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল বা হার্ট ফেইলিওর হওয়ার পর জানা যায়, যে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ছিল। বেশির ভাগ সময় অন্য কোনো কারণে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে গেলে ধরা পড়ে উচ্চ রক্তচাপ আছে। কিন্তু জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে পারলে সঠিক সময়ে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করা সম্ভব, এতে আরও বেশি লোককে সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এ জন্য বয়স ৪০ বছর পেরোলেই বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ মাপুন।
যদি পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকে, যদি আপনি ওজনাধিক্য বা স্থূলতায় আক্রান্ত হন, তবে তো অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন হবেন। এর বাইরে যখনই যেকোনো কারণে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যাবেন, বা যখনই সুযোগ হবে, তখনই রক্তচাপ মাপুন। চাকরিতে প্রবেশ করলে বাৎসরিক চেকআপ বা প্রতিবেদনের সময় রক্তচাপ মাপুন। মানে নিজের রক্তচাপের দিকে সতর্ক নজর রাখুন।
প্রতিকার
রক্তচাপ বেশি পাওয়া গেলে প্রথমেই যা করতে হবে, তা হলো জীবনাচরণ পরিবর্তন। লবণ কম খেতে হবে, পাতে আলাদা লবণ একদম খাওয়া চলবে না। ওজন বেশি থাকলে কমিয়ে ফেলতে হবে। সঠিক বিএমআই বা উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। তেল–চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে। বেশি করে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। কায়িক শ্রম বাড়াতে হবে। দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটা ভালো। জীবনযাপনে এটুকু পরিবর্তন আনলেই রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। একবার ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন খেতে হবে, তাই ওষুধের প্রতি অনেকের প্রথমে অনীহা থাকে।
প্রথম কথা হলো, শুরুতে সবাইকে ওষুধ দেওয়া হয়, তা নয়। অনেকের সামান্য বেশি রক্তচাপ পাওয়া গেলে সাধারণত জীবনাচরণ বদলের পরামর্শ দেওয়া হয় এবং পরে আবার মেপে দেখতে বলা হয়। তবে কারও শুরুতেই অনেক বেশি রক্তচাপ থাকলে আর জীবনাচরণ পরিবর্তনের পরও রক্তচাপ বেশি পাওয়া গেলে অবশ্যই ওষুধ খাওয়া উচিত। হ্যাঁ, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সারা জীবনই খেতে হয়, কিন্তু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি যে সুফল পাবেন, তা আজীবন ওষুধ খাবার যন্ত্রণা ও ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, আগেই বলেছি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতা দেখা দেবে আর তাতে ওষুধের পরিমাণ ও খরচ বাড়বে বই কমবে না। এমনকি মৃত্যু বা পক্ষাঘাত বা অন্ধ পর্যন্ত হওয়ার আশঙ্কা, বাকি জীবন ডায়ালাইসিস করে চলতে হতে পারে। তাই দরকার হলে রক্তচাপের ওষুধ সারা জীবন চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে খেতেই হবে।
অনেকে রক্তচাপ স্বাভাবিক হলে ওষুধ বন্ধ করে দেন বা অনিয়মিত খান। এটাও ঠিক না। ওষুধ খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই মাপলে স্বাভাবিকই পাবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া যাবে। রক্তচাপ বেশি নেমে গেলে বা ওঠানামা করলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা বা ডোজ পরিবর্তন করা যাবে বা প্রয়োজনে ওষুধই পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। আরেকটা কথা, কার জন্য কোন ওষুধ প্রযোজ্য, সেটাও চিকিৎসকই ভালো বুঝবেন। অমুকের রক্তচাপ ওই ওষুধে নিয়ন্ত্রণে আছে বলে সেটা আপনিও শুনে শুনে খেতে পারবেন, তা নয়। তাই আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী বা দোকানদারের কথায় নয়, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান।
প্রতিরোধ
আজকাল অনেক কম বয়সেই মানুষের উচ্চ রক্তচাপ দেখা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো মন্দ খাদ্যাভ্যাস, ওজন বৃদ্ধি আর কায়িক শ্রমের অভাব। এখনকার শিশু–কিশোরেরা ছোটবেলা থেকেই উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও রিফাইন্ড খাবার গ্রহণ করে। তাদের খেলাধুলা ও ছোটাছুটির জগৎও সংকীর্ণ, ঘরে মুঠোফোনে বা কম্পিউটারের পর্দায় সীমিত। তা ছাড়া বেড়েছে মানুষের মানসিক চাপ বা স্ট্রেস। ওজন বাড়ছে, স্থূল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই অল্প বয়সেই দেখা দিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ।
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে হলে পরিবার থেকেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাড়িতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কম লবণ, কম তেল–চর্বি ও বেশি তাজা শাকসবজি ফলমূল খেতে হবে সবাইকে। নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রম করতে হবে। শিশুদের খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। ধূমপান বর্জন করতে হবে। এর বাইরে দরকার নিয়মিত স্ক্রিনিং বা রক্তচাপ মাপা। উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে নিয়মিত ওষুধ সেবন ও অন্যান্য অভ্যাসের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। কোনো জটিলতা হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখা। এভাবেই এই নীরব ঘাতকের সঙ্গে মোকাবিলা করা সম্ভব।



 
                                