জরায়ুমুখ ক্যানসার কতটা নিরাময়যোগ্য
 January 21, 2022
January 21, 2022
                                        
                                            
                                             1741 Views
1741 Views
                                        
                                        
                                            
                                     
                                        জরায়ুমুখে ক্যানসার খুব ধীরে ধীরে হয়। তবু দেশের নারীদের ক্যানসারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এটি। বিশেষ করে সমাজের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এবং শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
তবে সহজে এবং খুব কম খরচে আক্রান্ত হওয়ার আগে ও প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার রোগ শনাক্ত করা যায়। এতে ক্যানসার নিরাময় হওয়ার সুযোগ থাকে প্রায় শতভাগ। রোগের পর্যায় যত বাড়তে থাকে, রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা ততই কমতে থাকে।
কেন হয়
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) গোত্রের একটি ভাইরাস জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী। এই ভাইরাস যৌন সংসর্গের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। যৌন সক্রিয় বেশির ভাগই কমবেশি এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সবার কিন্তু ক্যানসার হয় না। কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদেরই ক্যানসার হয়ে থাকে। ক্যানসারের ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো:
- বাল্যবিবাহ বা কম বয়সে সহবাস।
- অধিক সন্তান ধারণ এবং ঘন ঘন সন্তান প্রসব।
- বহুগামিতা।
- ধূমপান।
- দীর্ঘদিন একনাগাড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন।
- নারী প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ।
- এইচআইভি/এইডস রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ঝুঁকি বেশি।
কীভাবে বুঝবেন
প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের কোনো লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। সে জন্যই নারীদের স্ক্রিনিং জরুরি। তবে সহবাসের পর রক্তক্ষরণ, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত শুরু হওয়া, অনিয়মিত বা অতিরিক্ত রক্তস্রাব, সাদা স্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত বা চাল ধোয়া পানির মতো স্রাব, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, যোনিপথ দিয়ে প্রস্রাব বা পায়খানা নির্গত হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
প্রতিরোধে করণীয়
১. প্রতিষেধক: ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত এইচপিভি টিকা দেওয়া যাবে। যৌন মিলন শুরুর আগেই এই টিকা নিলে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। টিকাটির তিনটি ডোজ রয়েছে। ১৫ বছরের আগে দেওয়া সম্ভব হলে দুটোতেই প্রতিরোধ সম্ভব। এ বছরে বাংলাদেশ সরকার বিনা মূল্যে কিশোরীদের এই টিকা দেওয়া শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু বিশ্ব এ বছরও করোনার টিকা উৎপাদন ও বিতরণে ব্যস্ত থাকবে বলে এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রদানে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
২. নির্ণয়: অন্যান্য ক্যানসারের সঙ্গে জরায়ুমুখ ক্যানসারের একটি বড় পার্থক্য হলো, এটি ক্যানসার পূর্ব অবস্থায়ই নির্ণয় করা সম্ভব। ক্যানসার পূর্ব অবস্থায় চিকিৎসা নিলে পুরোপুরি ক্যানসার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তাতে একজন মেয়ে তার স্বাভাবিক নারীত্ব বজায় রাখতে পারে এবং ব্যয়বহুল ক্যানসার চিকিৎসা ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
স্ক্রিনিংয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা করতে হয়: এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট, প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট এবং ভায়া টেস্ট।
এই টেস্টগুলো অত্যন্ত কার্যকর এবং সহজলভ্য। সরকার বিনা মূল্যে ৩০-৬৫ বছর বয়সী নারীদের ভায়া টেস্টের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। জেলা শহরগুলোতে প্যাপ টেস্ট ও এইচপিভি শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রয়েছে।
টিকা দিলেও স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে। এই টেস্টগুলো ৩-৫ বছর পরপর করা হয়ে থাকে। তাই প্রয়োজন সচেতনতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের নারীরা জরায়ুমুখ ক্যানসারের অ্যাডভান্সড স্টেজে বা অনেক দেরিতে চিকিৎসকের কাছে আসেন, অনেক ক্ষেত্রেই যখন আর সফল চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই এ বিষয়ে কুসংস্কার ও সংকোচ পরিহার করতে হবে।
চিকিৎসা
জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। নির্ভর করে রোগটি কোন পর্যায়ে ধরা পড়েছে, তার ওপর। এই চিকিৎসাগুলো বেশ ব্যয়বহুল এবং যন্ত্রণাদায়ক। তাই প্রতিরোধ ও ক্যানসার পূর্ব অবস্থায় নির্ণয় করার দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।
জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা মাস
জানুয়ারিজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা মাস’ পালিত হয়। এই ক্যানসার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়ে থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে নারীদের ক্যানসারজনিত কারণে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ জরায়ুমুখ ক্যানসার। ২০২০ সালে বিশ্বে ৬ লাখের বেশি নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ নারীই মারা যান। একই সময়ে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মারা যাওয়া সংখ্যা যথাক্রমে ৬ হাজার ২৬৮ ও ৪ হাজার ৯৭১।
অথচ জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। এই ক্যানসার নির্মূলের লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ক্যানসার নির্মূল বলতে বোঝায় প্রতি লাখে বছরে চারজনের নিচে নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হারে নামিয়ে আনা। এ জন্য গৃহীত কর্মসূচিগুলো হলো:
১. টিকা কার্যক্রম : ১৫ বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোরীর এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রদান সমাপ্ত করা।
২. স্ক্রিনিং : ৭০ শতাংশ নারীকে জীবনে অন্তত দুবার (৩৫ ও ৪৫ বছরের মধ্যে) মানসম্পন্ন স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা।
৩. চিকিৎসা : ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্যানসার-পূর্ব অবস্থায় শনাক্ত করার মাধ্যমে সফল চিকিৎসা প্রদান এবং ৯০ শতাংশ নারী যাঁরা ক্যানসারে আক্রান্ত, তাঁদের চিকিৎসার আওতায় আনা।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশে এই ৯০-৭০-৯০ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হলে আগামী শতাব্দীর শেষে পৃথিবী থেকে ক্যানসারটি নির্মূল হবে বলে আশা করা হয়।
লেখক: গাইনি অনকোলজিস্ট, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
তথ্য সূত্র: প্রথমআলো।



 
                                